
রঙে রঙে রঙিন বসন্ত ফুরোতে না ফুরোতেই চলে এলো বাঙ্গালীর প্রানের উৎসব নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া পহেলা বৈশাখ। সেই উৎসব ঘিরে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। ব্যস্ততায় কাটলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সেল, জামা কাপড়, সাজুগুজু কেনার ব্যস্তময় দিনগুলো। বৈশাখের প্রথম প্রহরেই নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে শুরু হলো আমার আবাসিক এলাকা বা সোসাইটির বৈশাখী আয়োজন। নাচে গানে, খানাপিনায় আনন্দোৎসবে সামিল হলাম আমরা।
বাংলা নতুন বছর ১৪৩২ এর প্রাক্কালে আমাদের এই শিল্পগোষ্ঠির উদ্যোগে প্রতি বছরের মত এবারেও ছোট্ট একটি গীতি আলেখ্যানুষ্ঠান "নব আনন্দে জাগো" মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিলো সেদিনের সকালটি। প্রতি বছরের মত আমাদের সাংস্কৃতিক কমিটির প্রধান আপার বাসায় মহা সমারোহে রিহার্সেলের পর শেষ হলো সেদিনের সকালের গান। এরপর ছিলো নাচ।

এসো শ্যামল সুন্দরও!!!

আইলো আইলো আইলো রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে ....
বলছিলাম রিহারসেলের কথা। মানে ঐ আপার বাসায় রিহার্সেল। আপার বাসায় কোনো গানের আয়োজন মানেই স্বপ্নীল ব্যপার স্যাপার। রাজপ্রাসাদের মত বসার ঘরটিতে থাকে গলা ভালো করার সকল উপাদান। আদা চা, লেবু চা, গরম পানি থেকে শুরু করে লং, আদা, জষ্ঠি মধু সবই। আর সাথে আছে নিত্য নতুন খানাপিনার আয়োজন।
আরেকজন আমাদের দলে আছেন বিশেষ সঙ্গীতজ্ঞ আপা। গানের সূর আর কথায় একটু এদিক সেদিক হলেই ধমক ধামকে সুরকে সঠিক পথে এনেই ছাড়ে। আরও আছেন শুভ্র সুন্দর স্নোহ্যোয়াইট আপা, ভীষন ভালোমানুষ আপা, ফ্যাশন মডেল আপা এবং ভীষন ঠোটকাঁটা আপা। ইনারা সবাই আমার থেকে বড় হলেও আমার সৃজনশীল প্রতিভার বেশ কদর করেন আর তাই আমি সেখানে একটু মাতবরী করার সুযোগ পাই আর কি।

তারা সবাই গান গেয়েছিলো কিন্তু আমি আমাদের সেই নব আনন্দে জাগো গীতি আলখ্যানুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে পড়া সকল কথামালায় কন্ঠ দিয়েছিলাম আর সেটা লিখেছিলামও। যদিও কন্ঠ নিয়ে তখন ভয়ে ভয়ে ছিলাম কারণ একই সাথে চলছিলো তখনই স্কুলের পাপেট শো কার্য্যক্রম আর সেখানেও কন্ঠ দিতে গিয়ে গলা প্রায় হয়ে উঠছিলো প্যাক প্যাক ফ্যাশ ফ্যাশ!
আমাদের নববর্ষের গানের পোশাক হবার কথা ছিলো মনিপুরি শাড়ির একেক রঙ। সকলেই গভীর মনোযোগে গান শেখার আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো মনিপুরী শাড়ি খোজার পালা। হা হা সে এক মজার কান্ড কীর্তি! একদিন রাতে প্রধান আপাকে অনলাইন মনিপুরী শাড়ির লিংক দিয়ে দেখি রাত ১ টা পার হয়ে গেছে। আপা কিচ্ছু বলেনি সেই রাত দুপুরে আমার মেসেজ পেয়েও। যাইহোক আমরা সবাই মেঘ অম্বরী নামে এক অনলাইন পেইজকে মনে হয় বড়লোক বানিয়ে দিয়েছি সেই ক'দিনেই। কারণ আমরা শিল্পীরা ছাড়াও বারিধারা সোসাইটির অন্যান্য মহিলা মেম্বারেরাও সেজেছিলেন সেদিন মনিপুরী শাড়িতে। আমি নিজে এত শাড়ি পরি তবুও জানতাম না মনিপুরী শাড়ির যে এত ধরন কদর আর আকাশছোঁয়া দাম আছে। আসলে মনিপুরী শাড়ির থেকে আমি বেশিভাগ গানের সময় জামদানীই শাড়িকেই প্রাধন্য দিয়ে থাকি।
যাইহোক এবারে আমরা আমন্ত্রন জানিয়ে ছিলাম আমার প্রিয় কিছু মানুষ মানে কয়েকজজন শিল্পীকে। তবে তারা শুধু আমার প্রিয় মানুষ হিসাবেই আসেনি। এসেছিলো অতিথি আর্টিস্ট হয়ে। এদের মাঝে একজন ছিলো আমার বিশেষ প্রিয় মানুষ। সে আমার অতি প্রিয় মনীষা। মনীষা কোথাও আঁকাআঁকি শেখেনি বটে তবে ঐ যে যাকে বলে জাঁত শিল্পী। যার কোনো আর্ট স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটির প্রয়োজন নেই।

আমি চাই তার গুনগুলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে....

একমাত্র ছেলে শিল্পীটার পোশাকটাই ছিলো একটা শিল্প!

শিল্পীদের সাথে কিছুক্ষন
যাইহোক সেই সকালে দেখা হয়ে গিয়েছিলো আমার কয়েকজন পিচ্চুপাচ্চু স্টুডেন্টদের সাথেও। সবার ছবি দেবার পারমিশন নেই তাই দুজনের দিলাম।

রাজকন্যা ঈরাবতীর সাথে...

রাজকন্যা চম্পাবতীর সাথে...

পান্তা ভর্তা লুচি পরোটা সব্জী সুজি মাংস চা কফি ফল ফুলুরী দিয়ে সে এক ভুরিভোজের আয়োজন ছিলো সেদিন সকালে ........ নতুন বছরের সকালটা মহানন্দেই কেটে গেলো ...... তারপর আসলো দুপুরের পালা ......
নববর্ষের দ্বিতীয় প্রহর...
নববর্ষের প্রথম প্রহরের পর শুরু হলো দ্বিতীয় প্রহর। এই দ্বিপ্রহরে আমার উনার বুয়েটিয়ান বন্ধু আর বন্ধুপত্নীদের সাথে অনেক জল্পনা কল্পনা আর পরিকল্পনায় মেশানো নববর্ষের আনন্দোৎসব। সকালে সবাই একই সাথে একই অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছিলাম। মেয়েদের সবার জন্য একই শাড়ি কেনা হয়েছিলো আর ছেলেদের জন্য একই জামা। পাঁচ বন্ধু যখন সেই একই জামা পরে আড্ডা দিচ্ছিলো, সবাই ঘুরে তাকালো। এমনকি টিভি চ্যানেলেরাও জিগাসা করতে লাগলো। আপনারা কারা ভাই! হা হা শুধু এখানেই না গেছিলাম দুপুরের খাবার খেতে আড়ং এর টেরাকোটায়। সেখানেও এক তরুন বালক এগিয়ে এলো। আপনাদের সাথে ছবি তুলতে পারি? বন্ধুত্বের এই অবাক বিস্ময়ে বিস্মিত সেই তরুণ!! সকালের গান গাওয়া মনিপুরি শাড়িটা বদলে বৈশাখী আয়োজনের দ্বিতীয় প্রহরের সেই শাড়িটা পরে আবার শুরু হলো আমার বৈশাখের দ্বিপ্রহরের পালা। আমাদের আমন্ত্রিত প্রিয় শিল্পীরা যারা আমার অনেক প্রিয় তারা বললো - আমার এনার্জী বটে ....... আবারও আরেক শাড়ি.... হা হা হা....
সবাই মিলে চলে গেলাম টেরাকোটা। সেখানে তো তিল ধারনের জায়গা নেই। অবশ্য আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিলো যদিও তারা কোনো বুকিং রাখে না। তবে আমাদের দলে স্পেশাল মানুষদের স্পেশালিটির জোরে বুকিং রেখেছিলো তারা। সেখানে দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে বিকাল বিকাল পৌছে গেলাম আমাদের ছাদঘরের বৈশাখী অনুষ্ঠানে।

গ্রামবাংলার মজাদার খানাপিনা। আপনঘর নামে এক অনলাইন শপে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছিলাম। প্রতিটা খাবার ছিলো অসাধারণ!
আমার যদিও একয়েকদিনে গানের রিহার্সেল ছিলো, স্কুলের পাপেট শো এর অনেক অনেক কাজ ছিলো তবুও আমি আমাদের বাসার এই অনুষ্ঠানকে যতখানি রঙ্গিন করে তোলা যায় সেই চেষ্টাটাই করেছিলাম প্রানপনে। মুড়ি মুড়কি গজা মোয়া নাড়ু সবকিছুর সাথে সাথে আমি আমাদের ছাদঘর বা আড্ডাঘরটাকে বৈশাখী সাজে রাঙ্গিয়ে তুলেছিলাম......





তারপর সবাই মিলে গান বাজনা হৈ চৈ। আমি তো আমার থেকে বয়স পেশা মেধায় সব বড় বড় মানুষদের উপরে আমার নার্সারী টিচিং চালিয়েই ফেল্লাম। বললাম আসো সবাই গান গাই, ঢোল বাঁজাই নাচি হাসি খেলি ...... আর অবাক হয়ে দেখলাম সবাই সবার বয়স পেশা গাম্ভীর্য্য সকল কিছু ভুলে ছেলেবেলার মত আনন্দে মেতে উঠলো ....... নাচতে না জেনেও মনের আনন্দে নাচা, গাইতে না জেনেও গাওয়া আর বাঁজাতে না জেনেও বাজানো সে আর কে পারে আমরা ছাড়া!

নতুন বছরের প্রথম দিনটা এত হাসি এত আনন্দ গানে বোধ হয় কাটেনি বহু বছর........ আমি যতই আনন্দে গান গাই, ঘর সাজাই এবারের বৈশাখ আর বৈশাখী আনন্দ তাদের আগমন ছাড়া পরিপূর্ণতা পেতো না..... এই ছবিগুলি দিতে পারলাম না অনুমতি ছাড়া।তাই নিজের ছবিই দেই।
আরও আরও উৎসবে...

নববর্ষের উৎসব যেন শেষই হচ্ছেনা এবার আমার। এত এত উৎসবে মুখরিত দিনগুলি। ক্লান্তিহীন আমি। অনেকেই আমার আশে পাশের মানুষজন জেনে গেছে যে এই উৎসবে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছি আমি। ক্লান্তিরাই উল্টে আমার কাছে ক্ষমা চাইছে যেন। যাইহোক আমার সহকর্মীদের অনেককেই বলেছিলাম ঠিক পহেলা বৈশাখের পরেরদিনটাতেই আমরা একসাথে মজা করে ভর্তা ভাত খাবো। কিন্তু ক্লান্তি ও নানা সমস্যার কারণে ঐ মহোৎসবের ঠিক পরেরদিনটাতে অনেকেই আসতে পারেনি।

তাই যারাই এসেছিলো তাদের সাথেই নাচে গানে আনন্দ ভালোবাসায় কেটে গেলো সে সন্ধ্যাটিও। বিশেষ পাওয়া ছিলো মেঘ না চাইতেও জলের মতন একজন গিটারিস্ট। খানাপিনার পর আমাদের ছাদবাগানের চাঁদের আলোয় বসেছিলো সেদিন রাতে চাঁদের হাঁট.......

অন্য বাড়ির উৎসবে.....
সে বলেছিলো, আপনি ফ্রি আছেন? আমি একটু আমার বাসায় কয়েকজনকে বলতে চাই। আমার তো এখন সেরাটোনিন ডোপামাইন হাই আমি সাথে সাথে বললাম অবশ্যই বলো আমি এখন উৎসব ম্যুডে আছি। তোমাকে আমাদেরকে দাওয়াৎ করতেই হবে। সে বললো ওকে ওকে করবো নিশ্চয়!!!
তারপর তার বাসায় ঢুকে প্রথমেই ডানদিকে ঘাড় ফিরিয়ে আমি তো অবাক বিস্ময়!!! এত সুন্দর একটা লাইব্রেরী!!!!! চক্ষুলজ্জায় চুপ থাকলাম । সে আমাদেরকে বসালো তার শান্ত ছিমছাম ড্রইং রুমে। আমার মন পড়ে আছে তার লাইব্রেরী রুমে। জানতে পেরে সে বললো সেখানেই বসেন কোনো সমস্যা নেই। তার আগেই আরেকজন তার ক্লসেট দেখে এসেছেন ওয়াসরুম যাবার নাম করে। আমাকে বললো লাইব্রেরী দেখবেন কি তার ক্লসেট দেখে আমার মাথা খারাপ!!!
সোজা কথায় অনেকদিন ধরে মহা ব্যস্ততায় কাটানো আমরা মানে পাপেট শো এর একরাশ ক্লান্তির পর সে ছিলো আমাদের বুক ভরে নিশ্বাস টেনে নেবার দিন.......হ্যাঁ সহকর্মী ও পাপেট টিমের একজনের বাসায় বৈশাখের অনুষ্ঠান।

আমার তো ওর লাইব্রেরী রুম থেকে ফিরতেই ইচ্ছা করছিলো না। খাবার পর আমরা তো সেই লাইব্রেরীতেই ঢুকলাম আর বেরই হলাম না। ছবি তুলতে তুলতে তুলতে, গিটার ইকেলালায় সূর তুলতে তুলতে তুলতে একদম সন্ধ্যা বানিয়ে ছাড়লাম.....
নববর্ষ স্কুল কার্নিভাল আর আমার পাপেট শো......

এবারের বৈশাখ যেন নতুন রুপে এসেছে। বারিধারা সোসাইটির গান, নাচ, ছবি আঁকাআঁকি, পুরোনো বন্ধুদের সাথে সারাদিন কাটিয়ে পরদিন স্কুলের প্রিয় সহকর্মীদের সাথে নতুন বছরের ভর্তা ভাত মুড়ি মুড়কি তারপরপরই চলে এলো আমাদের স্কুলের নববর্ষ বরণ।

পুতুল নাচ বা পাপেট শো এটা আমার অনেক অনেক আনন্দময় কাজগুলোর মাঝে একটা কাজ। যদিও প্রতিবছর আমি বাচ্চাদেরকে পড়ানোর পাশাপাশি আমার স্কুলের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকি আর তাই আমার এই পুতুলনাচ টিমের একটি বিশেষ কাজই থাকে মাঝেমাঝেই পুতুলনাচ পরিবেশনা। সে স্কুলের মাঝেই হোক বা স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করতে স্কুলের বাইরেই হোক না কেনো। এই পুতুলনাচ শুধু পুতুলকে নাচানোই নয়, এই পুতুলনাচের মাধ্যমে আমরা কিছু শিখাতে চাই। তাই আমরা পুতুলনাচ বা পাপেট টিমের সদস্যরা পুরোনো গল্পগুলোর সাথে শিক্ষনীয় বিষয়গুলো নিয়ে পুতুলনাচ পরিবেশন করে থাকি । আমরা ২০১০ থেকে প্রায় প্রতি বছরেই এই পুতুলনাচ পরিবেশন করে আসছি। আমাদের পরিবেশিত জনপ্রিয় পুতুলনাচের মাঝে রয়েছে পান্তাবুড়ি। যা অনেক স্কুলেই পরিবেশিত হয়েছে। আরও রয়েছে গুপী গায়েন ও বাঘা বায়েন, কুঁজো ও সাত ভূত, রাখাল ছেলে ও বাঘ, জিদ, করোনাভাইরাস ও হাবু, যাচ্ছে গাবু স্কুলেতে, জলপরী ও কাঁঠুরে, টুনটুনি ও রাজার গল্প ইত্যাদি।

আমাদের এবারের পরিবেশনা ছিলো পুতুলনাচ বোকাজামাই। যা জসীমুদ্দিনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প "কিছুমিছু"র ছায়া অবলম্বনে তৈরী করেছিলাম। যদিও নানারকম পুতুল বা পাপেটের মাঝে রয়েছে সুতা পুতুল বা স্ট্রিং পাপেট , হ্যান্ড পাপেট বা হাত পুতুল, রড পাপেট বা শিক পুতুল ও শ্যাডো পাপেট বা ছায়া পুতুল। তবে আমাদের এবারের পুতুলনাচে আমরা ব্যবহার করেছিলাম রড পাপেট বা শিক পুতুল। নীচে পুতুল নাচ বোকাজামাই এর রিহারসেল ভিডিওটা দিচ্ছি। অফিশিয়ালটা এখনও হাতে পাইনি!
যাইহোক বৈশাখের আনন্দ এবারে যেন আশেপাশে একটু বেশিই অনুভব করেছি। সাথে নিজেও মেতেছিলাম একই আনন্দে। সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ভালো থাকুক সবাই। অনেক অনেক ভালো। নতুন বছরে এই প্রত্যাশায় কেটে যাক সকল বেলা .......

পুতুলনাচ বোকাজামই এর ইউটিউব লিঙ্ক
এই পোস্ট সেই এপ্রিলে লিখে রেখেছিলাম আজ রানার ব্লগ ভাইয়ুর কথা শুনে পাবলিশ করে দিচ্ছি। তাই এই পোস্ট রানার ব্লগ ভাইয়ুকে উৎসর্গ করা হলো।
সাথে করুনাধারা আর মেহবুবা আপুনিকেও.....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


